বর্তমান বিশ্বে মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে অথবা মোট GDP এর দিক দিয়ে শীর্ষ ধনী দেশগুলোর প্রায় সবই অবস্থিত ইউরোপ,আমেরিকা মহাদেশে। গত ২০০ বছর পশ্চিমা কলোনিয়াল শক্তিগুলো সারা বিশ্বে ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিল সম্পদের পাহাড়। ইউরোপ, আমেরিকার নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা ও কথিত মুক্ত বাণিজ্যের নামে একবিংশ শতাব্দীতেও পশ্চিমারা ধরে রেখেছে তাদের উচ্চ মাথাপিছু আয়। ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে নিজেদের দেশের।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মাথা পিছু আয় যেখানে যথাক্রমে ৬৮ হাজার ও ৫১ হাজার মার্কিন ডলার, বিপরীতে বাংলাদেশ মাথা পিছু আয় মাত্র ২ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। আজকের ভিডিওতে জানার চেষ্টা করবো বাংলাদেশ কেন পশ্চিমাদের মতো ধনী দেশ হচ্ছে না? ঠিক কি কারনে পশ্চিমারা এতো ধনী দেশ? জানতে হলে দেখতে থাকুন ভিডিওটি শেষ পর্যন্ত।
আর যারা জিওপলিটিক্স, বিশ্বের সকল দেশ ও ইসলামিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চান তাহলে অবশ্যই আমাদের চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করবেন। এবার যাওয়া যাক মূল ভিডিওতে।
একটি দেশ উন্নত দেশ হওয়ার জন্য রয়েছে দুটি পথ, একটি পথ হচ্ছে নিজ দেশে শিল্প পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের ভিতরে ভোগ্য পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করা। উদ্রিত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা। যেখানে গুরত্ত দেওয়া হয় নিজদেশের ভিতরে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করা।
আর দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে নিজ দেশে শিল্প পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে শুধুমাত্র বিদেশে রপ্তানিকে গুরত্ত দেওয়া। এতে করে অটোম্যাটিক ভাবেই মানুষের আয় বাড়বে পাশাপাশি মানুষের আয় বাড়লে অটোম্যাটিক ভাবেই বৃদ্ধি পাবে ভোগ্য পণ্যের চাহিদা। উপরের ১ম পদ্ধতিতে একটি দেশ উন্নতি করতে সময় লাগবে কয়েকশো বছর, আর দ্বিতীয় পদ্ধতিতে উন্নতি করতে সময় লাগবে ২০/৩০ বছর। বর্তমানে সিঙ্গাপুর, কোরিয়া ও চীন ব্যাবহার করছে এই ২য় পথটি।
বাংলাদেশ ইউরোপীয়দের মত ধনী দেশ না হওয়ার অন্যতম কারন বাংলাদেশের শিল্প পণ্য উৎপাদন ক্ষমতা। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তি পণ্যের উৎপাদন নেই বললেই চলে। এখন অনেকেই আমার ভিডিওতে গলাবাজি করে বলবেন আমরা সব তৈরি করি। আমি তাদেরকে বলবো আমাদের দরকার যদি হয় ১ কোটি আমরা তৈরি করি ১ লাখ।
বাংলাদেশের মোট আমদানি রপ্তানির হিসেব দেখলেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন। গত বছর করোনার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমান ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিন্ম, তাই আমরা এর আগের বছরের হিসেবটি দেখবো। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমান ছিল ৪৭.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপরীতে আমদানির পরিমান ছিল ৫৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এখন মনে করুন বাংলাদেশ একটি পরিবার, এই পরিবারের আয় ৪৭.২ বিলিয়ন ডলার আর খরচ ৫৫.৬ বিলিয়ন ডলার। তাহলে এই পরিবারের লস হয়েছে ৮.৪ বিলিয়ন ডলার। এখন অনেকেই প্রশ্ন করবেন তাহলে তো বাংলাদেশ প্রতি বছর গরীব হয়ে যাওয়ার কথা।
আসলেই তাই এবাবে চললে বাংলাদেশ গরীবই হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু গরীব হচ্ছে না এর অন্য তম কারন বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্স। গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশে রেমিটেন্স আসে ১৬.৪১ বিলিয়ন ডলার।
এখন মোট হিসেব করলে দেখা যায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট আয় রপ্তানি বাবদ আয় ৪৭.২ বিলিয়ন এবং বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্স ১৬.৪১ বিলিয়ন সব মিলিয়ে ৬৩.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর খরচ আমদানি বাবদ ৫৫.৬ বিলিয়ন ডলার। সব কিছু একত্রে হিসেব করলে দেখা যায় বাংলাদেশের লাভের পরিমান ৮.০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার দেখা যায় সরকার প্রতি বছর এই ৮.০১ বিলিয়ন থেকে ২/৩ ডলার খরচ করে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংক থাকা আনা লোণ পরিশোধের জন্য। এমন কচ্ছপ গতিতে চললে বাংলাদেশের উন্নতি করতে লাগবে কয়েকশো বছর।
গত ৭৮ বছরে ধরে ভারত ও ৫০ বছরে ধরে বাংলাদেশ এখনো ইউরোপীয়দের শিখানো ভুয়া পদ্ধতি অনুসরণ করার কারনেই আমরা গরীব ও উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আছি। আমরা যদি সিঙ্গাপুরের আমদানি রপ্তানির হিসেব দেখি তাহলে আমরা স্পষ্ট বুজতে পারবো সিঙ্গাপুর কেন ধনী দেশ।
আয়তনের দিক দিয়ে ভারতের চেয়ে প্রায় ৫ হাজার গুন ও বাংলাদেশের চেয়ে ১৫০ গুন ছোট দেশ সিঙ্গাপুরের মোট রপ্তানির পরিমান ৬২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বিপরীতে ভারতের রপ্তানির পরিমান মাত্র ৩১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সিঙ্গাপুরের আমদানির পরিমান ৫৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ভারতের আমদানির পরিমান ৪৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে সিঙ্গাপুরের লাভ হয়েছে ৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ভারতের লস হয়েছে ১৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে ভারতে বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্সের পরিমান মাত্র ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব কারনেই গত ২০২০ সালে ভারতের অর্থনীতি ১০% কমে যায়।
বাংলাদেশ যদি উন্নত দেশের কাতারে নিজেদের নাম লেখাতে চায় তাহলে চীন ও সিঙ্গাপুরের মত দ্রুত গতিতে রপ্তানিমুখী শিল্প কাঁরখানা ঘড়ে তুলতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার একটি কাজের বিনিময়ে ১০০০ বাড় মাইকিং করে থাকে। এই যেমন ১৫ বছরে মাত্র ১টা পদ্মা সেতু করে জনগণকে চেতনার বেলুন হাতে ধরিয়ে দিল। জনগনও চেতনার বেলুন হাতে নিয়ে খুশি আর সরকারও খুশি।
বাংলাদেশের রপ্তানি করা পণ্যের তালিকা দেখলে বুজতে পারবেন বাংলাদেশ কেন উন্নতি করছে না। ৪৭.২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৪২.৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য হচ্ছে টেক্সটাইল পণ্য। বাকি ৪.৬ বিলিয়ন পণ্য হচ্ছে চামরাড় জুতা, ব্যাগ, মাছ, গরু ছাগলের মাংশ এবং বিভিন্ন প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য। যেখানে উচ্চ আধুনিক প্রযুক্তির কোন পণ্য নেই বললেই চলে। কারন আমাদের দেশে কোন উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প কাঁরখানা নেই বললেই চলে। সরকারই ফাও ঢোল পিটাইতে পারদর্শী কাজের কাজ কিছুই না।
বিপরীতে আমরা আমদানি করে থাকি ৫৫.৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য যেখানে ১২.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্যই হচ্ছে তুলা ও বিভিন্ন প্রকারের সুতা। আমাদের টেক্সটাইল শিল্পের জন্য এই ১২.৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা জরুরী, কারন আমাদের দেশে তুলা উৎপাদন হয় না। ৩ নাম্বারে রয়েছে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের তেল জাতীয় পণ্য সামগ্রী। এই পণ্য গুলো আমদানি করার মূল কারন আমাদের দেশে কোন তেলের খনি নেই।
১ম ও ৩য়, এই দুই ক্যাটাগরিতে আমরা প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করলেও বাকি ক্যাটাগরির ৩৫.২ বিলিয়ন ডলারের বেশীর ভাগ পণ্যই উৎপাদন করা সম্ভব আমাদের দেশে। যেমন ২য় ক্যাটাগরিতে আমদানি করা ১০ বিলিয়ন ডলারের ইলেকট্রিক পণ্য, ৪র্থ ক্যাটাগরিতে থাকা ৫.৩ বিলিয়ন ডলারের রড ও স্টিল, এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের কেমিক্যাল, বড় বড় কাঁরখানার মেশিন, গাড়ির ইঞ্জিন ও বিভিন্ন পার্স। এই সবগুলো পণ্যই আমাদের দেশে উৎপাদন সম্ভব।
বাংলাদেশের চেয়ে ১৫০ ছোট দেশ সিঙ্গাপুর যেখানে ৬২৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমান মাত্র ৪৭ বিলিয়ন ডলার। সিঙ্গাপুরের কিছু না থাকা সত্ত্বেও ওরা সব ধরনের আধুনিক শিল্প পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম। কারন সিঙ্গাপুর আশেপাশের সব দেশ থেকে কাঁচামাল কিনে এনে নিজ দেশে ফাইনাল প্রোডাক্ট তৈরি করে আবার ঐ দেশ গুলোতেই বিক্রি করে। পাশাপাশি বিশাল একটি অংশ রপ্তানি করে থাকে ইউরোপ আমেরিকায়।
কাজেই রপ্তানি মুখী উচ্চ প্রযুক্তির আধুনিক শিল্প পণ্যের উৎপাদন বেতিত বাংলাদেশের উন্নতি কখনই সম্ভব না। মোবাইল কম্পিউটার গাড়ির যন্ত্রাংশ সহ বিভিন্ন মেশিনাদি আমদানির কারণে প্রতি বছরই খরচ হয় বড় অংকের টাকা। এই পণ্য গুলো যদি সরকার নিজ দেশে উৎপাদন করতে সফল হয় তাহলে বিদেশ থেকে আমদানির বদলে বাংলাদেশ উল্টো রপ্তানি করতে পারবে বিদেশে। এখন যে সকল পণ্য আমদানির জন্য সরকারের খরচ হচ্ছে তখন ঐ পণ্য রপ্তানির কারণে উল্টো আয় হবে সরকারের।
রপ্তানিমুখী শিল্প পণ্য উৎপাদনে আরও বেশী গুরত্ত দিবে সরকার। এমন আশায় শেষ করছি আজকের ভিডিও। আল্লাহ হাফেজ।
0 Comments